নগই’র ইতিহাস
নদী গবেষণা ইনস্টিটিউট-এর ইতিহাস
(প্রাক্তন হাইড্রলিক রিসার্চ ল্যাবরেটরি)
হাইড্রলিক রিসার্চ ল্যাবরেটরির ৩০ বছর
সূচনা
১। নদী সম্পর্কিত সমস্যাসমূহ খুবই জটিল এবং একটি ব্যয়বহুল নকশা মাঠ পর্যায়ে বাস্তবায়নের পূর্বে এর সঠিক সমাধানের জন্য পরীক্ষাগারে বৈজ্ঞানিক তদন্ত এবং গবেষণা প্রয়োজন। নদী ও অন্যান্য হাইড্রলিক সমস্যা সম্পর্কিত গবেষণা পানিসম্পদ উন্নয়নের জন্য গৃহীত প্রকল্প গুলোর ব্যয় সংকোচন এবং ত্রুটিপূর্ণ নকশা বাস্তবায়নের বিপুল খরচের অপচয় হতে সুরক্ষা প্রদান করে থাকে। কোন প্রকল্প বা নকশার গবেষণা ও অনুসন্ধান ব্যয় উক্ত প্রকল্পের মোট ব্যয়ের তুলনায় অতি ক্ষুদ্র।
২। ১৯৪৭ সালের ১৪ আগষ্ট ব্রিটিশ শাসন থেকে মুক্তি পাওয়ার পর ১৯৪৩ সালে কোলকাতায় প্রতিষ্ঠিত নদী গবেষণা ইনস্টিটিউট, বাংলা দেশ বিভাগের কারনে ভারতের পশ্চিম বঙ্গে অন্তর্ভুক্ত হওয়ার পরিপ্রেক্ষিতে তদানিন্তন পাকিস্থানের পূর্ব বাংলা প্রাদেশিক সরকার সেচ বিভাগের অধীনে নদী ও তৎসম্পর্কিত পরীক্ষা নিরীক্ষা, অনুসন্ধান ও গবেষণা কার্যক্রম পরিচালনার নিমিত্ত একটি গবেষণাগার প্রতিষ্ঠার প্রয়োজনীয়তা অনুভব করেন। ১৯৪৮ সালের মাঝামাঝি সময়ে সরকার ঢাকায় “হাইড্রলিক রিসার্চ ল্যাবরেটরি (এইচআরএল)” নামে একটি নতুন গবেষণাগার প্রতিষ্ঠার পরিকল্পনা অনুমোদন করে। কোলকাতা থেকে প্রকাশিত "The Statesman" এর ঢাকার স্টাফ রিপোর্টার কর্তৃক উক্ত পত্রিকায় ১৯৪৮ সালের ১২ই আগস্ট “এইচআরএল” অনুমোদন সম্পর্কিত একটি প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়। পটভূমি হিসেবে উক্ত প্রতিবেদনের অংশবিশেষের অনুবাদ এখানে উত্থাপন করা হলো........ “নদী ও তৎসম্পর্কিত সমস্যাসমূহ সাফল্যের সাথে সমাধানের নিমিত্ত ঢাকায় “হাইড্রলিক রিসার্চ ল্যাবরেটরি” প্রতিষ্ঠার প্রস্তাব এবং এজন্য ১,২২,০০০/= টাকা অনুমোদন করা হয়েছে। প্রতিষ্ঠানটি প্রদেশের প্রধান নদীসমূহের হাইড্রলিক তথ্য সংগ্রহ ও নদী সম্পর্কিত সমস্যাসমূহের বৈজ্ঞানিক গবেষণায় সক্ষম হবে।” “কুলি রোড (বর্তমান গ্রীন রোড)” –এ প্রতিষ্ঠানটি প্রতিষ্ঠার জন্য স্থান নির্ধারন করা হয় এবং ৪ একর নিম্ন ভূমি সহ মোট ১২ একর জায়গা ১৯৪৯ সালের শেষ নাগাদ সরকার কর্তৃক অধিগ্রহন করা হয়। অধিগ্রহনকৃত জায়গাটিতে একে অপরের সাথে সংযুক্ত দুটি পুকুর ছিল। “এইচআরএল” এর পরীক্ষামূলক কাজের শুরু থেকেই রিসার্কুলেটিং খাল ও সাম্প এর মাধ্যমে হাইড্রলিক মডেল স্ট্যাডি-র কাজে উক্ত পুকুর দুটির পানি ব্যবহার করা হয়। স্থানটিতে অধিগ্রহণের সময় থেকেই তৎকালীন সরু কুলি রোডের পাশে কিছু ছোট, আধা-পাঁকা শেড ছিলো যেগুলি প্রতিষ্ঠান প্রতিষ্ঠার প্রাথমিক অবস্থায় স্টোর, গার্ড রুম ও কিছু নিম্নপর্যায়ের কর্মচারীর বসবাসের স্থান হিসেবে ব্যবহৃত হয়েছে।
৩। ১৯৫০ সালের দিকে স্থানটি ঢাকা শহরের একেবারে বাইরে ছিল এবং এলাকাটিতে কোন আবাসিক ভবন ছিল না, তবে ১৯৬০ সাল এবং তার পরবর্তী সময়ে এলাকাটিতে আবাসিক ভবন স্থাপিত হতে থাকে। ১৯৫৫ সালের দিকে কুলি রোডটি পাকা করা হয়েছিল। ১৯৬২ সালে কুলি রোডকে প্রশস্ত করে বর্তমান অবস্থানে আনা হয় এবং তখন এই রাস্তা সংলগ্ন এইচআরএল এর পুরাতন স্থাপনাসমূহ অপসারন করা হয়। ১৯৫৫ সালের পূর্বে এইচআরএল এর কর্মকর্তা/কর্মচারীগণ ঢাকা শহর থেকে (যা এখন পুরাতন ঢাকা নামে পরিচিত) ঢাকা- টঙ্গি বাসে করে কাওরান বাজার রেল ক্রসিং অথবা ফার্মগেট নেমে মাটির রাস্তা দিয়ে হেঁটে এবং কিছু কর্মকর্তা/কর্মচারী (গবেষণা কর্মকর্তা (পদার্থবিদ্যা) সহ) ১৯৬১ সাল পর্যন্ত পুরাতন ঢাকার বিভিন্ন এলাকা থেকে বাই সাইকেলে করে এইচআরএল এ পৌছাত। ১৯৪৩ সালে গবেষণা ইনস্টিটিউট, বেঙ্গল এর গবেষণা কর্মকর্তা (পদার্থবিদ্যা) হিসাবে নিয়োগপ্রাপ্ত জনাব এম. এ. রহমান পাকিস্থান সরকারের অধীনে কাজ করার শর্তে ১৯৪৭ সালের আগষ্ট মাসে ঢাকায় আসেন এবং শুরু থেকেই হাইড্রলিক রিসার্চ ল্যাবরেটরীর ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা হিসাবে দায়িত্বপ্রাপ্ত হন। তিনি ০৯/১২/১৯৫৮ এ উপ-পরিচালক, ০১/০১/১৯৬০ এ ভারপ্রাপ্ত পরিচালক এর দায়িত্বপ্রাপ্ত হন এবং ০১/০১/১৯৬৩ থেকে ৩১/০১/১৯৭৪ পর্যন্ত এইচআরএল এর পরিচালক হিসাবে দায়িত্ব পালন করেন। তিনি এইচআরএল এর প্রতিষ্ঠা, উন্নয়ন এবং সংশ্লিষ্ট ক্ষেত্রে গবেষণায় অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখেন। দেশের প্রয়োজনীয়তা এবং বরাদ্দ প্রাপ্তির ভিত্তিতে ১৯৪৮-১৯৭৮ সাল পর্যন্ত ৩০ বছরের মধ্যে ধাপে ধাপে এইচআরএল এর উন্নয়ন করা হয়। ১৯৫১ সালের শেষের দিকে নূন্যতম প্রয়োজনীয় সুবিধাদি নির্মান শেষে এইচআরএল ভৌত মডেল পরীক্ষা-নিরীক্ষার জন্য প্রস্তুত হয় এবং ১৯৫২ সালের জানুয়ারী থেকে ভৌত মডেল পরীক্ষা-নিরীক্ষার কাজ শুরু করা হয়। শুরুতে ল্যাবরেটরীতে মুলত কর্ণফুলি হাইড্রো-ইলেকট্রিক প্রোজেক্ট এর পরীক্ষা-নিরীক্ষার কাজ সম্পন্ন করে। ১৯৫২ সালের মাঝামাঝি সময়ে গবেষণা কর্মকর্তা (রসায়ন) এর নিয়োগ এবং যোগদানের পর এইচআরএল এ মৃত্তিকা বলবিদ্যা বিভাগ চালু করা হয়। তাঁর আওতায় ১৯৫৬-৫৭ এবং ১৯৫৯-৬০ সালে যথাক্রমে পলল বিশ্লেষণ বিভাগ এবং কংক্রিট ও উপকরণ পরীক্ষণ বিভাগ চালু করা হয়।
হাইড্রলিক রিসার্চ স্টেশন, ওয়ালিংফোর্ড, ইংলেন্ড এর তৎকালীন পরিচালক স্যার ক্লদে ইনগ্লিস কিং ১৯৫৩ সালের ২২ ফেব্রুয়ারি এইচআরএল পরিদর্শন করে মন্তব্য করেন যে, “খুব ভালো সূচনা কিন্তু নদী এবং জোয়ার-ভাটা সম্পর্কিত সমস্যা, নদী ভাঙ্গন, চরের উৎপত্তি, সর্পিল পথ ও জোয়ার-ভাটার তীক্ষ্ণতা সম্পর্কে গবেষণার জন্য এটি বৃহৎ পরিসরে সম্প্রসারণ করা প্রয়োজন।”
উন্নয়ন ও আধুনিকায়ন
১৯৫৫ সালের আগষ্ট মাসে ২৫.১৫মি × ১৫.৭০মি জায়গার উপর গবেষণাগার নির্মাণের জন্য সরকার বরাদ্দ প্রদান করে। ভবনটির নীচ তলা ১৯৫৭-৫৮ সালে, দ্বিতীয় তলা ১৯৫৯-৬০ সালে এবং সি. এই. শিটের ঢালু ছাদ বিশিষ্ট তৃতীয় তলা ১৯৬৩-৬৪ সালে নির্মান সম্পন্ন হয়। সরকার ১৯৫৬ সালের মার্চ মাসে ল্যাবরেটরী পরিচালনার জন্য একটি ক্ষুদ্র স্থায়ী জনবল কাঠামোও অনুমোদন করে। উক্ত অনুমোদনের পূর্বে তিন জন গবেষণা কর্মকর্তা ও কিছু সহকারী কর্মচারীর সমন্বয়ে একটি অস্থায়ী জনবল কাঠামো বছরভিত্তিক অনুমোদন সাপেক্ষে কাজ করে এসেছে। ১৯৫৬ সালে একজন পরিচালক, একজন উপ-পরিচালক, তিনজন সসহকারী পরিচালক (পূর্বের গবেষণা কর্মকর্তা) এবং কিছু অধস্তন গবেষণা এবং প্রশাসনিক কর্মকর্তার সমন্বয়ে স্থায়ী জনবল কাঠামো অনুমোদন করা হয়। ১৯৫৯ সালে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্থান পানি এবং বিদ্যুৎ উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ এর অধীনে আসার আগে পর্যন্ত গবেষণাগারটির উন্নয়নে তেমন কোন অগ্রগতি হয়নি। কারিগরী কর্মকর্তা এবং কর্মচারী স্বল্পতার কারণে গবেষণা কাজের অগ্রগতি ভীষণভাবে বাধাগ্রস্থ হচ্ছিল। গবেষণাগারের জন্য প্রয়োজনীয় মেধাবী বিজ্ঞানী এবং প্রকৌশলীদের আকৃষ্ট করা ও এখানে ধরে রাখা খুবই কঠিন ছিল।
হাইড্রলিক রিসার্চ ল্যাবরেটরির উন্নয়নের জন্য পি. সি. ১ প্রস্তুত করা হয় এবং ৩১/১০/১৯৫৫ তারিখে তৎকালীন পাকিস্তানের প্রথম পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনায় জমা দেয়া হয়। উক্ত পি. সি. ১ ১৯৬০ সালের আগষ্ট মাসে তৎকালীন পাকিস্তান সরকার কর্তৃক অনুমোদিত হয়।
দ্বিতীয় পষ্ণবার্ষিকী পরিকল্পনার সময় তদানিন্তন পূর্ব পাকিস্তান পানি এবং বিদ্যুৎ উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ এর পরামর্শক প্রতিষ্ঠান মেসার্স আই. ই. কোং. ইন্ক. জেনারেল কনসালটেন্ট থেকে একজন পানি গতিসংক্রান্ত প্রকৌশলী এবং একজন মৃত্তিকা প্রকৌশলীকে গবেষণাগারে ১৯৬০-১৯৬২ সাল পর্যন্ত ২ বছরের জন্য এবং পরবর্তীতে একই পরামর্শক প্রতিষ্ঠান থেকে ১৯৬৩-১৯৬৫ সাল পর্যন্ত দুই বছরের জন্য দুই স্বল্প মেয়াদে দুই জন পানি গতিসংক্রান্ত প্রকৌশলী এবং একজন মৃত্তিকা প্রকৌশলীকে গবেষণাগারের সহকারী কারিগরী কর্মকর্তা ও কারিগরী কর্মকর্তাদের তত্বীয় বক্তৃতা, নোট এবং ব্যবহারিক প্রদর্শনের মাধ্যমে বিশেষভাবে পানি গতিসংক্রান্ত ও মৃত্তিকা বলবিদ্যা সংক্রান্ত প্রশিক্ষণের নিমিত্ত এইচআরএল এ সংযুক্ত করা হয়। এই কর্মকর্তাদের বেশির ভাগই ১৯৬০ থেকে ১৯৬৪ সালের মধ্যে নিয়োগপ্রাপ্ত হয়েছিল এবং প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত দক্ষ কর্মকর্তাদের যে তীব্র সংকট ছিল তা অনেকাংশে লাঘব হয়, যার ফলে গবেষণা কাজের সংখ্যা এবং গুণগত মানের প্রভূত উন্নয়ণ ঘটে। কর্ণফুলী পানি বিদ্যুৎ প্রকল্পের কাজ সম্পন্ন হওয়ার পর প্রকল্পের জন্য নিয়োগকৃত ও প্রকল্প চলাকালীন সময়ে মেসার্স ইন্টারন্যাশনাল ইঞ্জিনিয়ারিং কোং. ইন্ক. কনসালটেন্ট দ্বারা প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত ৬১ জন মৃত্তিকা ও কংক্রিট টেকনিশিয়ান উদ্বৃত্ত্ব হয়ে পরে, যাদের পূর্বকালীন পানি ও বিদ্যুৎ উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ ১৯৬১ থেকে ১৯৬২ সালের মধ্যে ধাপে ধাপে আত্মিকরন করে এবং তাঁদের দক্ষতা গবেষণাগার ও বিভিন্ন প্রকল্প স্থানের মৃত্তিকা ও কংক্রিট কার্যসমূহের মান নিয়ন্ত্রণের কাজে ব্যবহারের জন্য হাইড্রলিক রিসার্চ ল্যাবরেটরির অধীনে ন্যস্ত করা হয়। সেসময় থেকে গবেষণাগারটি প্রধান প্রকৌশলী এবং প্রকল্প পরিচালক/তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলীদের চাহিদা মোতাবেক বিভিন্ন প্রকল্পের ফিল্ড সেবার জন্য মৃত্তিকা ও কংক্রিট টেকনিশিয়ানদের পুল হিসেবে কার্যক্রম পরিচালনা করে আসছে।
অনুমোদিত পি. সি. ১ এর আওতায় এইচআরএল এর উন্নয়ন কর্মসূচী ১৯৬০ সালের ডিসেম্বর মাসে শুরু হয়। বিভিন্ন প্রস্তাবিত স্থানে ভূমি সংকটের কারনে অনেক বছর পর্যন্ত পি. সি. ১ অনুযায়ী আবাসিক ভবন নির্মাণ করা সম্ভব হয়নি । আবাসিক ভবন নির্মাণ ব্যতিত সরকারের বরাদ্ধকৃত সমস্ত অর্থ পরীক্ষাগার নির্মাণ, সরঞ্জাম এবং যন্তপাতি ক্রয়ের জন্য ব্যবহৃত হয়েছিল। ১৯৬৫ সালের জুন মাসের মধ্যে পরীক্ষাগারে, (ক) একটি তিন তলা বিশিষ্ট পূর্বে উল্লেখিত মাঝারি মাপের ভব্ (খ) হাইড্রলিক মডেলের জন্য একটি ৩৬.৫৯মি × ২৭.৪৪মি (১২০ফিট × ৯০ফিট) বিশিষ্ট খোল-ছাদ আচ্ছ্বাদিত শেড, (গ) সি. আই. শিট দ্বারা নির্মিত ছাদ বিশিষ্ট একটি কনক্রিট ল্যাবরেটরী ও একটি মাঝারি মাপের ওয়ার্কশপ, (ঘ) ৭৬.২২মি. × ৪৫.৭৩মি. (২৫০ফিট × ১৫০ফিট) ক্ষেত্র বিশিষ্ট একটি উন্মুক্ত ফ্লুম মডেল, যেখানে বড় নদীগুলোর মডেল স্থাপিত, (ঙ) পুনঃনিরীক্ষা সুবিধা সহ দুটি বড় সাম্প, (চ) খোল-ছাদ আচ্ছ্বাদিত শেডের নীচে একটি ১.২২মি. (৪ফিট) প্রশস্থ এবং ৩২.৩২মি. (১০৬ফিট) দীর্ঘ একদিকে স্বচ্ছ প্লাস্টিক শিট বিশিষ্ট ফ্লুম, একটি পাম্প হাউস এবং পলল পরিবহন স্ট্যাডির জন্য পুনঃনিরীক্ষা সুবিধা সম্বলিত একটি পাম্প, (ছ) জোয়াড় ভাটা স্ট্যাডির জন্য উজানের সরবরাহ ও বিভিন্ন সুবিধাযুক্ত একটি পাইলট টাইডাল মডেল, এবং (জ) উন্মুক্ত জায়গায় নদী মডেল করার জন্য মাটি দ্বারা ভরাটকৃত প্রাঙ্গণে প্রায় ২ একর এলাকাবিশিষ্ট ০.৯২ মি. থেকে ১.৫২ মি. গভীর নিম্ন ভূমি।
১৯৬৩ সালের শেষের দিকে এটা উপলব্ধি হয় যে, একটি আধুনিক গবেষণাগারের জন্য আরও অনেক কাজ করা প্রয়োজন। বিদ্যমান যন্ত্রপাতি ও সুবিধাসমূহ ক্রমবর্ধমান সমস্যাবলী নিয়ে গবেষণার জন্য একেবারেই অপর্যাপ্ত ছিলো। ১৯৫৫ সালে মূল প্রাক্কলনটি প্রস্তুত করা হয় এবং ১৯৬৩ সাল নাগাদ একটি সুসজ্জিত গবেষণাগারের ব্যাপারে জ্ঞান এবং ধারনাসমূহের বৈপ্লবিক পরিবর্তন সাধিত হয়। জোয়ার-ভাটা, উপকূলীয় ভূমি ক্ষয়, বন্যা নিয়ন্ত্রণ এবং বন্দর ও পোতাশ্রয় সম্পর্কিত সমস্যা মোকাবিলার নিমিত্ত গবেষণার জন্য গবেষণাগারে পর্যাপ্ত সংখ্যক যন্ত্রপাতি ও স্থানের সংকুলান ছিলো না। প্রকৃতভাবে এটি ছিল একটি বিশাল দুর্বলতা এবং এটা প্রবলভাবে উপলব্ধি করা হয়েছিল যে, বৃহৎ পানি উন্নয়ন সম্পর্কিত প্রকল্পসমূহের গবেষণা চাহিদা মেটাতে গবেষণাগারের উন্নয়ন ও আধুনিকায়নের জন্য প্রস্তুতকৃত মূল প্রাক্কলনটি পুঙ্খানুপুঙ্খ পুনঃবিবেচনা প্রয়োজন। আরও উপলব্ধি হয় যে, বৃষ্টি এবং দুর্যোগপূর্ণ আবহাওয়ার সময় পর্যাপ্ত আচ্ছাদন না থাকলে এইচআরএল চত্বরের নদীর মডেলের জায়গাটি সম্পূর্ণরূপে ব্যবহার করা যাবে না। গবেষণাগার চত্বরে প্রায় ২ একর এলাকা ৩.০৫ মি. থেকে ৩.৬৬ মি. (১০ফুট × ১২ফুট) নিচু ভূমি ছিলো এবং মাটি ভরাটের মাধ্যমে উক্ত ভূমিকে নদী মডেলের জন্য ব্যবহার উপযোগী করা প্রয়োজন ছিলো। মৃত্তিকা বলবিদ্যা, উপকরণ বিভাগের জন্য একটি পৃথক ভবন, মূলত অভ্যন্তরীন মডেলের জন্য ৯১.৪৬মি. × ৬০.৯৮মি. (৩০০ফুট × ২০০ফুট) মাপের হ্যাঙ্গার সদৃশ গবেষণাগারের একটি মূল ভবন, একটি ওয়েভ বেসিন, সর্পিল গতি, জোয়ার-ভাটা, উপকূলীয় ভূমি ক্ষয় এবং বন্দর ও পোতাশ্রয় সম্পর্কিত সমস্যা মোকাবিলার গবেষণার জন্য একটি ফ্লুম প্রয়োজনীয় হয়ে দাঁড়ায়। এমতাবস্থায় মূল প্রাক্কলনটি উপরেল্লিখিত কারনে এইচআরএল গবেষণাগারের অধিকতর উন্নয়ন ও আধুনিকায়নের জন্য সংশোধন করা হয়। সর্বমোট সংশোধনকৃত ব্যায় দাড়ায় ১,৩৫,৬৬,০০০.০০ টাকা যার মধ্যে বৈদেশিক মুদ্রার অংশ ছিল ২৫,১৪,০০০.০০ টাকা। ১৫.০৬.১৯৬৫ তারিখে একই কাজের সংশোধিত পি. সি. ১ প্রস্তুত করে দাখিল করা হয়। ইহা পরবর্তীতে আবারো সংশোধন করে বৈদেশিক মুদ্রার অংশ ২৫,১৪,০০০.০০ টাকা সহ সংশোধিত ব্যয় ১,৯২,৩২,০০০.০০ টাকা ধরে ১৯.০৪.১৯৬৭ তারিখে পুনঃ দাখিল করা হয়। কেন্দ্রীয় উন্নয়ন কর্ম সংস্থা (সিডিডব্লিউপি) এর সাথে আলোচনা শেষে ২৮.০৮.৬৮ তারিখে বৈদেশিক মুদ্রার অংশ ১৯,৬২,০০০.০০ টাকা সহ মোট ৬৮,০৬,০০০.০০ টাকায় প্রাক্কলনটি পুনরায় সংশোধিত হয়। সর্বশেষ সংশোধিত প্রাক্কলনে কর্মচারীদের আবাসিক ভবন নির্মাণ ব্যয় সিডিডব্লিউপি এর নির্দেশনা অনুযায়ী হ্রাস করা হয় এবং ১৯৬০ সালের জুলাই মাস থেকে শুরু করে ১০বছর কর্মসময়ের মধ্যে সম্পাদনের শর্তে ১৯৬৮ সালের ডিসেম্বরে অনুমোদিত হয়। অনিবার্য কারনবশত সর্বশেষ সংশোধিত প্রাক্কলনে অন্তর্ভুক্ত দুইটি প্রধান অংশ যথা, গবেষণাগার ভবন ও হ্যাঙ্গার সদৃশ শেড এর নির্মান কাজ নির্ধারিত সময়ের মধ্যে সম্পন্ন করা সম্ভব হয়নি। বৈজ্ঞানিক যন্ত্রপাতির অধিকাংশের ক্রয় সম্পন্ন হয়। তত্সত্ত্বেও, এইচআরএল প্রাঙ্গনের প্রায় ২ একর নিচু ভূমি পরিকল্পনামাফিক নদীর মডেলের কাজ করার জন্য প্রয়োজনীয় উচ্চতা পর্যন্ত ভরাট ও যান্ত্রিকভাবে ঠাসা হয়, যেখানে পরবর্তী বছরগুলোতে জি. কে. ইনটেক চ্যানেল মডেল এবং গ্যাঞ্জেজ ব্যারেজ মডেলের কাজের প্রয়োজনীয় সুবিধাসমূহ গড়ে তোলা হয়। বাংলাদেশের স্বাধীনতার পর বৈদেশিক মুদ্রার অংশ ২৩,১১,০০০.০০ টাকা সহ মোট ২,৭১,২০,০০০.০০ টাকায় প্রাক্কলনটি সংশোধিত হয় এবং সে মোতাবেক পি. সি. ১ প্রস্তুত করে ০৪.১০.৭৩ তারিখে দাখিল করা হয়। গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের এক্সিকিউটিভ কমিটি অব ন্যাশনাল ইকনোমিক কাউন্সিল (ইসিএনইসি) ০৪.০৭.৭৫ তারিখে সম্পূর্ণ অর্থে প্রাক্কলনটি অনুমোদন করে। অনুমোদিত প্রাক্কলনে ১,০৮,৩৪,০০০.০০ টাকা ব্যয়ে কর্মচারীদের আবাসিক ভবন নির্মান অন্তর্ভূক্ত ছিলো। পি. সি. ১ অনুযায়ী প্রস্তাবিত সংশোধিত জনবল কাঠামোও ১৯৭৭ সালের মে মাসে অনুমোদন করা হয়, যেখানে একজন পরিচালক, দুইজন অতিরিক্ত পরিচালক, সাতজন উপ পরিচালক (টেকনিক্যাল), একজন প্রশাসনিক কর্মকর্তা ও একজন নির্বাহী প্রকৌশলী সহ সর্বমোট ২৯৩ জন কর্মকর্তা-কর্মচারী অন্তর্ভুক্ত ছিলো। মৃত্তিকা বলবিদ্যা ও উপকরণ গবেষণাগার স্থাপনের জন্য ৩৬.৫৯মি. × ১৪.৭৯মি. মাপের চার-তলা বিশিষ্ট গবেষণাগার ভবন (মৃত্তিকা বলবিদ্যা ভবন নামে পরিচিত) এর নির্মান কাজ ১৯৭৬-৭৭ অর্থবছরে শুরু হয়ে ১৯৭৯-৮০ অর্থবছরে সম্পাদিত হয়।
প্রতি তলার নির্মাণকাজ সম্পন্ন হওয়ার সাথে সাথে ক্রমান্বয়ে মৃত্তিকা বলবিদ্যা, উপকরণ, পলল ও রসায়ন গবেষণাগার, লাইব্রেরী এবং অঙ্কন শাখা ধাপে ধাপে নতুন গবেষণাগার ভবনটিতে স্থানান্তরিত করা হয়, যার ফলে পূর্বে যেসব যন্ত্রপাতি ও উপকরণ স্থাপন করা যাচ্ছিলো না সেসব যন্ত্রপাতি ও উপকরণ কে কার্যোপযোগী করার মাধ্যমে গবেষণাগারের পরীক্ষণ সক্ষমতা বহুলাংশে উন্নীত হয়।
তদানীন্তন প্রাদেশিক সরকার কর্তৃক ১৯৪৮ থেকে ১৯৬০ পর্যন্ত রাজস্ব বাজেটের বিপরীতে ব্যয় ছাড়াও এইচআরএল এর উন্নয়নের জন্য এইচআর এর পি. সি. ১ এর বিপরীতে ১৯৬০ থেকে ১৯৭৮ সালের মধ্যে সর্বমোট ১০৮ লক্ষ টাকা ব্যয় করা হয়। তিন দশক পর্যন্ত মডেল সুবিধাদি নির্মাণ ও হাইড্রলিক মডেল স্ট্যাডির জন্য স্থানীয়ভাবে পাম্প, মটর ও অন্যান্য যন্ত্রপাতি ক্রয়ের জন্য সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন প্রকল্প/গ্রাহক থেকে বিপুল পরিমাণ স্থানীয় মুদ্রা অর্জন করা হয় এবং উক্ত উন্নয়ন সুবিধাদি এইচআরএল এর ভবিষ্যৎ গবেষণার জন্য সম্পদে পরিনত হয়।
১৯৭৮ সালের ২৯ আগস্ট এইচআরএল তার সকল কর্মকর্তা-কর্মচারী, সম্পদ ও দায় সহকারে সম্পূর্ণরূপে নদী গবেষণা ইনস্টিটিউট (আরআরআই), বাংলাদেশের সাথে একীভূত হয় এবং এইচআরএল নাম বিলুপ্ত হয়ে নদী গবেষণা ইনস্টিটিউট (আরআরআই), বাংলাদেশ নাম ধারণ করে। যতদিন ফরিদপুর শহরের অদূরে আরআরআই এর নির্ধারিত স্থানের ভূমি উন্নয়ন ও কাজের সুবিধাদির নির্মাণ কাজ চলছিলো ততদিন আরআরআই এর বিভিন্ন বিভাগের গবেষণা ও পরীক্ষণ কার্যক্রম ৭২, গ্রীন রোড, ঢাকায় পূর্বতন এইচআরএল এর প্রাঙ্গণে সম্পাদিত হয়।